বুকরিভিউ
বই: শেষ
লেখক : জুনায়েদ ইভান
প্রকাশনী: কিংবদন্তী পাবলিকেশন
প্রচ্ছদ: সঞ্চিতা সৃষ্টি
পৃষ্ঠা: ১১২
"শেষ" বইটির নাম শুনলেই ভিষণ রকমের কৌতূহল সৃষ্টি করে ভেতরে ভেতরে। সেখানে এমন প্রশ্নরা থাকতে পারে, এটা কি প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির শেষ? একটি অস্তিত্বের শেষ? নাকি কোনো অনুভূতির শেষ? লেখাটি পড়লে নিজের মধ্যেই গুলিয়ে যাবেন। সব কিছুর মিষ্টি সমাপ্তি হয় না। মানব জীবনও কখনও পরিপূর্ণ হয় না। হুট করেই শেষ হয়ে যায় আবার শেষ থেকেই শুভ সূচনার ধারা প্রাপ্ত হয়। বইটি পড়লেই তা খোলাসা হয়ে যাবে।
উৎসর্গ:
লেখক বইটি তার বাবা কে উৎসর্গ করেছেন। একটা বইয়ের আসলে এমন উৎসর্গই হওয়া সমিচীন। লেখা টা ছিল এমন- আমার বাবা সিংহের মতো না, সিংহের স্বভাব হলো সে যত শক্তিশালীই হোক না কেন, সব সময় পালানোর জন্য একটা জায়গা সে রাখে। আমার বাবা বট গাছের মতো। পড়ন্ত রোদের ছায়ার দরকার হলে আমি বট গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়াই। রোদ যে এত সুন্দর সেটা ছায়ার ভেতরে থেকে না তাকালে বুঝতে পারতাম না।
লেখক পরিচিত :
১৯৮৮ সালের আগস্ট মাসে লেখকের জন্ম। তার জন্ম হয়েছিল ভোরবেলায়। তখন চারদিক থেকে আজানের শব্দ ভেসে আসছে। এর ভেতরে রোগা- লিকলিকে একটা শিশু হাত পা নাড়িয়ে জানান দিচ্ছে, " আমি এসেছি, আমার কোনো অনুলিপি নেই"।
তিনি এমবিএ করেছেন একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এখন তিনি একটা রক ব্যান্ডের লিড ভোকালিস্ট। ফ্যামিলিতে, মা- বাবা, ছোট দুই বোন, ইশিতা আর অর্ণিমা। বতর্মানে তারা আমেরিকায় পড়ালেখা করছেন।
লেখক বলছেন, "এক বার এক বইয়ের মলাটে লেখক পরিচিতি বয়ানে একটা লেখা পড়েছিলাম, অনেকটা এরকম, লেখকের কোনো বাড়ির ঠিকানা থাকে না। তার পরিচয় বইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠায়। শব্দে-শব্দে, অক্ষরে-অক্ষরে। আমার কাছেও তাই মনে হয়। বইয়ের ভেতরে যে চরিত্র গুলো ভিন্ন ভিন্ন মতে একমত হন, লেখক এবং তার চরিত্র পৃথক সত্তা।
বই কথন:
"শেষ" উপন্যাসটির চরিত্র অনেক গুলো হলেও বার বার ঘটনার প্রেক্ষিতে যারা এসেছেন তারা হলেন- শিহাব, হাসান, নিতু, রুদ্র ও রফিক সাহেব। এই পাঁচ চরিত্র নিয়েই শুভ সূচনা। শিহাব একজন সাদাসিধে মানুষ। মা বাবা মারা যাওয়ায় তার নিজের বাসায় মন টিকে না বিধায় সে নিজের বাসা ছেড়ে একা থাকে। সাদাসিধে মানুষ টা রাত জেগে লেখে। তার লেখার বিষয়বস্তু ইলিউশন, ভিলিউশন ও হ্যালুসিলেশন কে ফিকশনে রূপান্তর করা। শিহাবের রুমমেট হাসান। যে কিনা একটা সুইসাইড নোট লিখে বাসা থেকে বের হয়ে যায় দড়ি কিনতে। দড়ি কিনার উদ্দেশ্য আত্মহত্যা। সে আত্মহত্যা করতে দড়ি কিনতে যায়। তবে দিন শেষে সে দড়ি না কিনে বাসায় ফিরে একটা অ্যাকুরিয়াম হাতে। সে আত্মহত্যা করবে না। শিহাব মূলত হাসান কে নানান নির্দেশনা দেন কিভাবে সহজ পদ্ধতিতে আত্মহত্যা করা যায়। কিন্তু হাসানের কোনো নির্দেশনাই ভালো লাগে না। যুক্তিযোগ্য মনে হয় না তার কাছে।
তেমনি একদিন শিহাব জানতে চায় হাসান আসলে কেন আত্মহত্যা করতে চায়। হাসান তার উত্তর দিতে ফিরে যায় অতীতে। যেখানে নিতু সাথে তার প্রথম দেখা। একটি ভুল স্টেশনে নেমে যায় তারা। সেখান থেকেই ঘটনা এগোতে থাকে।
নিতু দুই বছর আগে কোথায় হারিয়ে গেছে জানতে চাইলে হাসান বলে, নিতুর আমার আগেও একটা ধূসর অতীত আছে। নিতু মূলত বাসা থেকে পালিয়ে খুলনা আসে আর সেখানেই আমাদের দেখা হয়। নিতুর প্রাক্তন স্বামী রুদ্র। তাদের প্রেম করে বিয়ে হলেও এক বছরের মাথায় রুদ্রর একটা অসুখ দেখা দেয়, ভুলে যাওয়ার অসুখ। সে এক পর্যায়ে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যায়। যেখানে নিতু কে ও চেনা বোধগম্য হয় না রুদ্রর। নিতু এক পর্যায়ে রুদ্র কে ডিভোর্স দিয়ে চলে আসে। তবে হঠাৎ রুদ্র সুস্থ হয়ে ফিরে আসে। নিতুর বাসায় গিয়ে ঠিকানা জোগাড় করে হাসানের বাসায় চলে যায়। সেখানে নিতু কে পায় না রুদ্র। হাসান বলে সে বাসায় নেই। রুদ্র হাসানের হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দিয়ে বলে নিতু কে দিতে কিন্তু হাসান সেটা নিতুর হাত অব্দি যেতে দেয় নি। সেখানেই গন্ডগোলটাই হয়। এক নিমিষেই হাসান আর নিতু নিমজ্জিত হয়ে যায়। দুইজন দুই তীরের ছায়া হয়ে যায়।
রফিক সাহেব পেশায় একজন প্রকাশক। যে কিনা শিহাব কে তিনশত টাকার বিনিময়ে গল্প দিতে বলে। কিন্তু শিহাব কোনো ভাবেই গল্প তার হাত পযর্ন্ত পৌঁছে দিতে সক্ষম হয় না। শিহাব গল্প দিতে পারে কিনা সেটা পুরো উপন্যাস পড়লেই বুঝতে পারবেন।
গল্পে আরো দুজন চরিত্র আছেন যারা উন্মাদ। বেশ ভালো লাগার মতো চরিত্র। যারা কিনা রাস্তার দুপাশে দাড়িয়ে রাতে বেলা চাঁদ কে ঘুড়ি বানিয়ে উড়ায়।এখানেও ঝাঝালো রহস্য।
ভালো লাগার কিছু উক্তি :
১) পৃথিবীতে সবাই মরার জন্য আত্মহত্যা করেনা। কেউ কেউ বাঁচার জন্য করে। কারণ মানুষ মরতে পারে কিন্তু ভুলতে পারেনা।
২) সকল মানসিক দুর্বলতার মধ্যে জীবনের প্রতি ভালোবাসা সবচেয়ে শক্তিশালী।
৩) মানুষ দুটো সময়ে চুপ করে থাকে যখন তার বলার কিছু থাকেনা আর যখন অনেক কথা থাকে কিন্তু মুখে বলতে পারেনা।
৪) যতটা না যাওয়া, তার চেয়ে বেশি যেতে চাওয়া।
মন্তব্য :
"শেষ" উপন্যাসটি বর্তমান সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে সামাজিক বাস্তববাদী একটি উপন্যাস। যখন অর্ধেক লেখায় আটকে গিয়েছি, তখন মাথা প্রায় উলোটপালট। প্রত্যেকটি বাক্যের পিছনে রয়েছে রহস্য। উপন্যাসের কাহিনী টা প্রথমে সবাই কে ঘায়েল করতে পারবেনা। যেখানে আত্মহত্যা করার জন্য দড়ি কিনতে যাওয়া হাসান বাসায় ফিরে অ্যাকুরিয়াম নিয়ে। হঠাৎ তার মাথায় কি এমন এল যে তার সিদ্ধান্ত বদলে দিল। রহস্য ছিল চারপাশে। নানা সম্পর্কের টানাপোড়ন ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে। যেখানে কেউ কারো হতে পারেনি। চারদিকে শুধু বিচ্ছেদের সুর ছিল বিরাজমান। সবাই তার জায়গা থেকে একা। তবে আমার কাছে মনে হয়েছে অদ্ভুত এক চরিত্র শিহাব। সেটা সবাই পড়লেই বুঝতে পারবেন। আমার মনে হয়েছে সে অসুস্থ ব্যাক্তি। তার মাথায় যেগুলো ঘুরে সেগুলো কোনো সুস্থ মানুষের কাজ নয়। উপন্যাসের ভাবমূর্তি অসাধারণ ছিল। সত্যি বলতে পুরো লেখাটাই ইউনিক। এই উপন্যাসে মিশর, ফ্রান্স আর গ্রিক রাজাদের কাহিনী এসেছে বিভিন্ন ভাব ধারায়। কথার প্রেক্ষিতে। যা সবাই কে টানবে। ইডিপাসের কাহিনী টা চোখে পড়ার মতো। তাছাড়া রবী ঠাকুর, কবি শেলি, জীবন চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা আর লিওর্নাদো কোহনের সেই বিখ্যাত গান যা মনে দাগ কাটার মতো।
এক কথায় অসাধারণ থেকেও অসাধারণ। জুনায়েদ ইভান ভাইয়ের হাত শক্ত না হলে এত ইউনিক শব্দ আর বাক্য তিনি গঠন করতে পারতেন না। আরও অনেক কিছুই বলা যেত বইটি সম্পর্কে কিন্তু তাহলে যারা এখনও বইটি পড়েননি তাদের বইটি পড়ার মজা নষ্ট হয়ে যেত তাই আর কথা বাড়াব না। আচা করি সবাই পড়বেন বইটি।
রিভিউ: সুমাইয়া আক্তার
Post a Comment